আলোচ্য কবিতায় কবি একবার বলেছেন “সূর্যালোক মনোরম মনে হ’লে হাসি।” আবার বলেছেন- “সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ’লে হাসি;”- কবির এই উদ্দেশ্যকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করো। ৫
ভূমিকা: কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তিবিন্যাস একেবারেই ভিন্নধর্মী, যতিচিহ্ন বা শব্দের সামান্য অদলবদলে পরিবর্তিত হয়েছে কবিতার মূল সুর অথবা অন্তর্নিহিত অর্থ। আলোচ্য ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাতেও ‘সূর্যালোক’ শব্দটির একাধিকবার ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। শব্দটি আলোচ্য কবিতার শুরুতে, মাঝে ও শেষে তিনবারই ভিন্নভাবে কবিবক্তব্য প্রকাশের সহায়ক হয়ে উঠেছে।
ব্যাখ্যা: কবি আলোচ্য কবিতার শুরুতেই প্রাণশক্তির উৎস হিসেবে সূর্যের বন্দনা করেছেন। তারপর কবিতার মাঝামাঝি জায়গায় এসে মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলেছেন; আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা মৃত্যুমিছিল, অন্নের জন্য মানুষের হাহাকারের মাঝেও দিব্যি ভালো আছি। সূর্যালোক তার সমস্ত শক্তি দিয়েও মানুষের চেতনার অন্ধকারকে দূর করতে পারছে না। এই অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে ‘সূর্যালোক মনোরম’ বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে প্রাপ্তির হাসি হাসে মধ্যবিত্ত, সুবিধাভোগী শ্রেণি তথা মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ। সূর্যালোক যেখানে নেই-ই, চতুর্দিকে নৈরাজ্যের ঘন অন্ধকার, তার মাঝে বসে নীতিভ্রষ্ট, তিমিরবিলাসী মধ্যবিত্ত নতুন ভোরের প্রত্যাশা করে, শুঁয়োপোকা যেমন তার চারপাশে গড়ে তোলে নিশ্চিন্ত আবরণ, স্বার্থপর মধ্যবিত্ত সমাজও তেমনই এক কৃত্রিম পরিবেশ নির্মাণ করে নিজের চারপাশে, যার অভ্যন্তরে শুধুই ‘মধ্যবিত্তমদিরতা’, আত্মকেন্দ্রিকতার আঁধার। বহির্জগতের বিপর্যয়, মানুষের ক্ষুধার্ত হাহাকার যে আবরণকে ভেদ করে মধ্যবিত্তের হৃদয়ে পৌঁছোয় না।
মন্বন্তরক্লীষ্ট এই সময়ে মানবিকতার সূর্যালোক বিলুপ্ত হয়ে ঘনিয়ে উঠেছিল লোভ-লালসা-স্বার্থপরতার তিমির। এই বেদনার্ত পরিবেশেও মধ্যবিত্ত হৃদয়হীন নাগরিক কোনো সমবেদনা অনুভব করেনি। যে সূর্যালোক তার চেতনার আলোকিত উৎস, প্রজ্ঞার আধার ছিল তা আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন। কবিতার শেষাংশে কবি বলেছেন “সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ’লে হাসি”-যখন মানবিকতাবোধ নিঃশেষ হয়ে যায় তখন সূর্যালোককে ‘প্রজ্ঞাময়’ বলে প্রচার করা, মানবতা নিয়ে স্থূল বাণী ছড়ানো নিছকই কৌতুককর হয়ে ওঠে। কবি জীবনানন্দ দাশ এভাবেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বিদ্রুপের কশাঘাতে আহত করেছেন, সত্যের মুখোমুখি না হয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গা-বাঁচানো মনোবৃত্তিকে আক্রমণ করতে চেয়েই তিনি বারবার এই কবিতায় সূর্যালোকের প্রসঙ্গ এনেছেন।