গীতিকবিতা হিসেবে জীবনানন্দ দাশের ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাটি কতখানি সার্থক তা লেখো

গীতিকবিতা হিসেবে জীবনানন্দ দাশের ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাটি কতখানি সার্থক তা লেখো। ৫

গীতিকবিতার স্বরূপ: প্রাচীন গ্রিসে Lyre বা বীণা সহযোগে গায়ক তার ব্যক্তিগত অনুভবকে সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করত, সেই সংগীতকেই বলা হত Lyric। এই Lyric-ই বাংলা গীতিকবিতার উৎস। পাশ্চাত্য লিরিকের মতো বাংলা গীতিকবিতার ক্ষেত্রেও কবিহৃদয়ের একান্ত ব্যক্তিগত ভাবাবেগ প্রাধান্য পায়। তবে কবিমনের আনন্দ-বেদনা গীতিকবিতার মূল বিষয় হলেও সার্থক আধুনিক গীতিকবিতায় বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর জীবন ও অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে। এমনকি প্রাচীন লিরিকের ক্ষেত্রেও কবির লেখনী দ্বারা ফুটে উঠেছে সাধারণ মানুষের আশা-নিরাশার কলরব। অর্থাৎ কবিমনের ব্যক্তিগত অনুভূতির সঙ্গে গীতিকবিতায় থাকে এক সর্বজনীন আবেদন। প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশপ্রীতি, ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক প্রভৃতি সকল বিষয় নিয়েই গীতিকবিতা রচিত হতে পারে।

সার্থকতা: “সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে আমাদের জীবনের আলোড়ন-“

সময়টা বিংশ শতাব্দীর চারের দশক। দেশভাগ-পূর্ববর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মন্বন্তর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে পর্যুদস্ত ভারতবর্ষে ঘনিয়ে উঠেছিল অবক্ষয়ের অন্ধকার। তারই মাঝে সমাজচেতনার সঙ্গে রোমান্টিক আত্মমগ্নতার মিশেল ঘটিয়ে আলোয় ফেরার গান গাইলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। আলোচ্য ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাটি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের চেতনার তিমিরকে বিনষ্ট করে গভীর আত্মোপলব্ধির সঞ্চার ঘটায়। আমাদের স্মরণ করায় যে আমরা ছিলাম সূর্যের জাতক, সত্যের পূজারী। মানবসভ্যতার শুরুতে একে অপরের প্রতি সহমর্মিতার দ্বারা ঐক্যবদ্ধ সমাজ আমরাই গড়ে তুলেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে সেই আমাদেরই ক্ষমতালিঙ্গু, আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের দরুন পৃথিবীতে নেমে এসেছে নৈরাজ্যের আঁধার। সেই আঁধার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কবি আস্থা রেখেছেন মানুষেরই শুভবুদ্ধির উপর। তিমিরের বিলাসিতা ছেড়ে আমরাই আবার চেতনার নবজাগরণে ‘তিমিরবিনাশী’ হয়ে উঠব এটাই কবির আশা। কবি এখানে মধ্যবিত্ত জনসাধারণেরই একজন হয়ে মানবসভ্যতার আলো-আঁধারের দ্বন্দ্বকে তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান সময়ের পাশাপাশি সভ্যতা সৃষ্টির প্রথম ভোরের কথা ইতিহাস-সচেতন কবির কবিতায় বারবার এসেছে। পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব, বিবর্তন, অস্তিত্বের সংকট এবং তার থেকে উত্তরণ-সবটুকুই কবি ব্যক্তিগত সুরেই প্রকাশ করেছেন কিন্তু একইসঙ্গে তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদেরই প্রতিনিধি। একজন যথার্থ গীতিকবির মতোই এই কবিতায় কবির, মানব ও প্রকৃতির দূরত্বকে অতিক্রম করার ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। তার সঙ্গে সংশয় ও বিপন্নতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এই কবিতাকে সার্থক আধুনিক গীতিকবিতা করে তুলেছে। চিত্রকল্পের যথার্থ প্রয়োগ এবং মননের ঔজ্জ্বল্য তাঁর গীতিকবিতার এক অদ্বিতীয় সম্পদ, আলোচ্য ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাতেও যার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কাজেই আধুনিক গীতিকবিতা হিসেবে ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাটি সর্বান্তকরণে সার্থক।

Leave a Comment