‘ছুটি’ গল্পে প্রকৃতির প্রভাব আলোচনা করো।
অথবা, ‘ছুটি’ গল্পের মর্মান্তিক পরিণতির পিছনে প্রকৃতির প্রভাব কতখানি, তা আলোচনা করো।
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখেছেন- “আমার – শিশুকালেই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আমার খুব একটা সহজ ও নিবিড় যোগ – ছিল।” হ্যাঁ, শিশুকাল থেকেই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সংযোগ। • প্রকৃতিকে তিনি যেমন ভালোবেসেছিলেন, প্রকৃতিও তাঁকে আপন করে নিয়েছিল শিশুকালেই। রবীন্দ্রমানসের কল্পনারসে জারিত হয়ে বিশ্বপ্রকৃতি স্থান করে নিয়েছে সর্বত্র- ‘ছুটি’ গল্পটিও যার ব্যতিক্রম নয়।
প্রকৃতির প্রভাব: নাগরিক জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার কাজে পৌঁছে যেতে হয়েছিল পদ্মাতীরবর্তী পল্লিবাংলার বিস্তীর্ণ সমভূমি শিলাইদহে। প্রকৃতির অসীম রহস্যময় সৌন্দর্য এবং প্রকৃতিলগ্ন মানুষের সহজসরল জীবনযাপন তাঁকে আপ্লুত করেছিল। এই শিলাইদহ পর্বে লেখা ‘ছুটি’ গল্পটিতে তাই প্রকৃতির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এ গল্পের নায়ক কিশোর ফটিক বড়ো হয়ে উঠেছে পল্লিবাংলার উদার-উন্মুক্ত পরিবেশে। খোলা আকাশ, নীচে দিগন্তজোড়া মাঠ, সীমাহীন নদীতীর আর একদল দামাল ছেলের নামহীন সাম্রাজ্যের রাজা সে। মায়ের ভর্ৎসনায় অভিমানী হয়ে, বয়ঃসন্ধির সময়ে নিজেকে বোঝা-না-বোঝার দ্বন্দ্বজটিলতায় মামার প্রস্তাবে রাজি হয়ে অসীম কৌতূহল নিয়ে সে পাড়ি দেয় কলকাতায়। সেখানে চারদেয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে গিয়ে মামির স্নেহশূন্য সংসারে সে হারিয়ে ফ্যালে জীবনের সহজ চাপল্য। এই বন্দিদশার আগল ভেঙে মুক্তমনের অবাধ বিচরণক্ষেত্রে ফিরে যেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তার অন্তর আদিগন্ত প্রকৃতির কাছে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে।
উপসংহার: আলোচ্য গল্পে আমরা দেখি খাঁচায় বন্দি বনের পাখির মতো অসহ্য যন্ত্রণা ফটিককে মুক্তির জন্য ব্যাকুল করে তুলেছে। সে বাড়ি ফিরতে চেয়েছে, ফিরে যেতে চেয়েছে প্রকৃতিলগ্ন জীবনের কাছে। ঘুড়ি ওড়ানোর বিস্তৃত মাঠ, সাঁতার কাটার সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী, অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানোর সীমাহীন নদীতীরটির প্রতি সে আশ্চর্য আকর্ষণ অনুভব করেছে। অবাধ-অগাধ স্বাধীনজীবনে ফেরার জন্য তার ব্যাকুলতা প্রকাশিত হয়েছে। মায়ের স্নেহাজ্বল এবং প্রকৃতির শ্যামলাঞ্চল-বঞ্চিত কিশোর ফটিক মায়া- মমতা-স্নেহ-ভালোবাসাহীন শহুরে পরিবেশ থেকে শেষে ছুটি নিয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রী ফটিক মাকে বলেছে-“মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।” ফটিকের এই ব্যঞ্জনাবাহী উক্তিতে রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার করেছেন, প্রকৃতির সঙ্গে যে সত্তা অভিন্ন, প্রকৃতির থেকে বিচ্ছেদে তার মৃত্যু অনিবার্য-সে মৃত্যু কায়িক অথবা মানসিক। ‘ছুটি’ গল্পের এই মর্মান্তিক পরিণতির পিছনে তাই প্রকৃতির প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় থাকে না।