ছোটোগল্প হিসেবে ‘ছুটি’ গল্পটি কতটা সার্থক হয়ে উঠেছে, তা আলোচনা করো

ছোটোগল্প হিসেবে ‘ছুটি’ গল্পটি কতটা সার্থক হয়ে উঠেছে, তা আলোচনা করো।

ভূমিকা: বাংলা ছোটোগল্পের সার্থক স্রষ্টা হলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনিই প্রথম ‘ছোটোগল্প’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ছোটোগল্প কেবল ভাবাশ্রয়ী- কল্পনামুখ্য নয়, বরং জীবননির্ভর এবং এতে রয়েছে খণ্ড কাহিনির ব্যবহার।

ছোটোগল্পকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘বর্ষা যাপন’ কবিতায় বলেছিলেন,

"নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা, 
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে 
শেষ হয়ে হইল না শেষ।"

ব্যাখ্যা: ‘ছুটি’ গল্পটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে প্রাকৃতিক বর্ণনা ব্যতীত কোনো ঘটনা বর্ণনার আতিশয্য এতে নেই। প্লট-এর বাহুল্য নেই, গ্রাম ও শহরের মধ্যেই গল্পটি ঘোরাফেরা করে। ফটিকের বেড়ে ওঠার গ্রাম্য প্রকৃতি থেকে উৎখাত হয়ে নাগরিক যান্ত্রিকতার মধ্যে এসে পড়ার চরম পরিবর্তন ছাড়া আর তেমন কোনো পরিবর্তন এই গল্পে নেই, শেষেও ফটিকের কী হল তার সুস্পষ্ট ধারণা আমরা পাই না-অতৃপ্তি নিয়েই গল্পটি শেষ হয়। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্যগুলি পুনরায় লক্ষ করা প্রয়োজন।

ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য: পূর্বোক্ত ‘বর্ষা যাপন’ কবিতায় কবিগুরু ছোটোগল্পের আরও একটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন-

“ছোটো প্রাণ ছোটো ব্যথা ছোটো ছোটো দুঃখ কথা”

জীবনের চলমান স্রোত থেকে খন্ড খন্ড প্রতীতি আহরণ করবেন গল্পকার। এখানে বিন্দুতে হবে সিধু দর্শন।

  • তত্ত্বকথা বা উপদেশ থাকবে না।
  • একমুখিতা হবে এই গল্পের বৈশিষ্ট্য।
  • বৃহত্তর সত্য, স্বল্পতম ব্যাপ্তির মধ্যে প্রতিফলিত হবে।
  • “অন্তরে অতৃপ্তি রবে/সাঙ্গ করি মনে হবে/শেষ হয়ে হইল না শেষ”
  • একটি মাত্র মহামুহূর্ত থাকবে এবং সমগ্র গল্পের উৎকণ্ঠা এর উপর নিবদ্ধ থাকবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘ছুটি’ গল্পটি বিবেচ্য।

ছোটোগল্পরূপে সার্থকতা: গল্পকার আলোচ্য গল্পে ফটিকের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় বন্ধন ও পরে বিচ্ছেদ-এই মূলভাব ও প্রতীতিকে নিয়ে গল্পের কাঠামো গড়ে তুলেছেন। ফলে ছোটোগল্পের একমুখিতার আদর্শ এখানে রক্ষিত হয়েছে। তবে পার্শ্ব উপকরণ হিসেবে গল্পে চিত্রিত হয়েছে ফটিকের কলকাতায় থাকাকালীন জীবনযাপনের কিছু খন্ড চিত্র। মামির উদাসীনতা ও নিষ্ঠুরতা, স্কুলে মাস্টারমশাইয়ের প্রহার, বই হারিয়ে ফেলা, মামাতো ভাইদের উপেক্ষা ইত্যাদি ফটিকের বেদনাকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। সমগ্র গল্পে উৎকণ্ঠা দানা বেঁধেছে এই বিশেষ মুহূর্তটিতে- “যে অকূল সমুদ্রে যাত্রা করিতেছে, বালক রশি ফেলিয়া কোথাও তাহার তল পাইতেছে না।” ফটিকের এই মৃত্যুবর্ণনা গল্পকারের সংযত ভাষানৈপুণ্যের পরিচায়ক। এ ছাড়া দুর্যোগপূর্ণ বর্ষণমুখরিত সেই রাত্রির অশান্ত পরিবেশে ফটিকের মানসিক বিপর্যয়কে গল্পকার ব্যঞ্জনাময় ও আবেদনস্পর্শী করে তুলেছেন।

উপসংহার: ‘ছুটি’ গল্পের মহৎ সত্য হল প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত মানবসত্তা প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হলে, সেই সত্তার অপমৃত্যু ঘটে। তাই গল্পের শেষে কোনো চমক নেই, আছে শাশ্বত জীবনসত্যের ধীর বিশ্বাস। ফলে ‘ছুটি’ গল্পটি যে একটি আদর্শ ছোটোগল্প হিসেবে বিবেচিত হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

Leave a Comment