“জীবিত বা মৃত রমণীর মতো অন্ধকারে-মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি।”- উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। ৫
তাৎপর্য: মানবসভ্যতার চিরকালীন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং মানবিকতা যখন মানুষেরই লোভ-লালসার শিকার হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল, তখন চতুর্দিকে ঘনিয়ে এল স্বার্থপরতার অন্ধকার। মানুষ তখন সূর্যালোকের মতো দীপ্তিমান প্রজ্ঞার আলোয় নয়, ঝাঁপ দিল জৈবিক ক্ষুধা মেটানোর অন্ধকারে। তার জীবনে তখন রমণী প্রিয়তমা নয়, হয়ে উঠল কেবলই ভোগ্যপণ্য। এমনকি সে জীবিত নাকি মৃত তা দিয়েও কিছু এসে যায় না, ব্যক্তির ভোগবাসনা বা প্রবৃত্তি চরিতার্থ হচ্ছে কিনা সেটাই আসল ব্যাপার। মানুষের নৈতিকতাবোধের অবক্ষয়কে এভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন কবি। উল্লেখ্য রমণী যেমন মানবসভ্যতার কাছে সেসময় কেবল ভোগবিলাস, পরিতৃপ্তির সামগ্রীরূপে প্রতীত হয়েছিল তেমনই মধ্যবিত্ত নাগরিককে তার ভোগবিলাসের সামগ্রী জুগিয়েছিল মহানগর। আর সেই ভোগ্যপণ্যের মদিরতায় সম্পর্কের বৈধতা-অবৈধতা বা আচরণের নৈতিকতা-অনৈতিকতার প্রভেদ কেবলই গুলিয়ে যায়। মানুষ ক্রমশ তলিয়ে যায় বিলাসিতার অন্ধকারে। কস্তুরী মৃগের নাভিনিঃসৃত সুগন্ধে মৃগ নিজেই যেমন মাতোয়ারা হয়ে ছুটে বেড়াতে থাকে, মধ্যবিত্ত সমাজও সেরকম নাগরিক সুখের নেশায় সমস্ত মানবিক ধর্মকে উচ্ছন্নে দিয়ে তিমিরবিলাসিতায় গা ভাসায়। মৃগনাভির জন্য হরিণ যেমন নাগরিক সমাজে পণ্য, ঠিক তেমনই আমাদের মনের লোভ-লালসাই আমাদের অবক্ষয়ের কারণ। আমরাও ওই কস্তুরী মৃগের মতোই নিজের মোহে উন্মত্ত, আত্মহারা। কবি জীবনানন্দ দাশের সচেতন শব্দ প্রয়োগে ‘জীবিত বা মৃত রমণী’ বা ‘মহানগরীর মৃগনাভি’ হয়ে উঠেছে স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, ভোগবিলাসী মধ্যবিত্ত নাগরিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলার সার্থক চিত্রকল্প।