“মধ্যবিত্তমদির জগতে/আমরা বেদনাহীন-অন্তহীন বেদনার পথে।”- ‘মধ্যবিত্তমদির জগতে শব্দবন্ধটির তাৎপর্য লেখো। ‘অন্তহীন বেদনার পথে বলতে কী বোঝানো হয়েছে

“মধ্যবিত্তমদির জগতে/আমরা বেদনাহীন-অন্তহীন বেদনার পথে।”- ‘মধ্যবিত্তমদির জগতে শব্দবন্ধটির তাৎপর্য লেখো। ‘অন্তহীন বেদনার পথে বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ২+৩

তাৎপর্য: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে যে নৈরাজ্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, যেন তারই প্রতিচ্ছবি ধরা পড়েছিল তেতাল্লিশের মন্বন্তরে। তাই কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন-

"মন্বন্তর শেষ হ'লে পুনরায় নব মন্বন্তর"

একসময় যে স্বর্ণযুগ অস্তিত্বময় ছিল, তা আজ অন্তর্হিত। তার জায়গায় বর্তমানে যেন নেমে এসেছে ধ্বংসের অন্ধকার। বর্তমানে কালের পথে উঠে এসেছে, গা-বাঁচিয়ে চলা মধ্যবিত্ত মানবশ্রেণি। সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষদের সঙ্গে এই মধ্যবিত্তদের মাঝখানের তফাৎটুকু কবি নির্দেশ করেন ‘এরা’-‘ওরা’ শব্দ দুটির প্রয়োগে। মন্বন্তরের দহনদিনে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ যখন ক্ষুধায় কাতর, তখনও মধ্যবিত্তশ্রেণি নিছকই বিমর্ষ হয়। কারণ তারা ‘মধ্যবিত্তমদির’। মদিরতা মানে মত্ততা। এই শ্রেণির মানুষেরা আত্মপ্রেমে মজে থাকে, এমতাবস্থায় অন্যকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার কথা এদের মনে আসে না। কারও কোনো দুরবস্থা এদের সামান্যতম পীড়িতও করে না। কবি একে এক ধরনের মদিরতা বলে ব্যঙ্গ করেছেন। মধ্যবিত্তজনের এই আত্মমত্ত, আবিষ্ট মানসিক অবস্থানকেই কবি এখানে ‘মধ্যবিত্তমদির’ বলে প্রকাশ করেছেন।

অন্তহীন বেদনার পথে-র অর্থ: নিম্নবর্গীয় মানুষজনকে মন্বন্তর উপহার দিয়েছিল- নর্দমা-ফুটপাথ-লঙ্গরখানা। এই পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভাবলে দেখা যায়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা সমাজজীবনে যে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, তাতে মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষজনও তাদের মূল্যবোধ ভুলে গিয়ে হয়ে উঠেছিল স্বার্থকামী, আত্মকেন্দ্রিক ও নিছক সুখে বেঁচে থাকার মন্ত্রে দীক্ষিত। নিম্নবিত্তরা ফুটপাথে ক্ষুধা-যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে মরে যেতে পারে, কিন্তু মধ্যবিত্তরা তা পারে না, কারণ তারা জীবনবিলাসী। আত্মকেন্দ্রিকতা বা স্বার্থপরতায় আক্রান্ত ‘এরা’ সমূহ বিপদ-ঝঞ্ঝা থেকে গা-বাঁচিয়ে আত্মরক্ষা করতে সদা তৎপর। জীবনের নিরাপদ বৃত্ত পরিধি ছুঁয়ে, আত্মসুখে নিমজ্জিত থাকাতে অভ্যস্ত। নগরের পথে-প্রান্তে মৃত্যুর মিছিল, বিঘ্নিত জীবনযাপনের পরিসরে নিরন্নতার হাহাকার, নিছক একটু ‘ফ্যান’-এর জন্য মানুষের ক্ষুধার্ত চিৎকার মধ্যবিত্ত মানুষকে ব্যথিত করে না, বিব্রত করে। তখন সেই ‘অন্তহীন বেদনার পথে’-র থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মধ্যবিত্ত ‘ভদ্র সাধারণ’ সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়। চতুর্দিকের এই বেদনাময় পরিস্থিতিতেও তার আত্মকেন্দ্রিকতার ঘেরাটোপে কোনো আঘাত লাগে না।

Leave a Comment