রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হল- ফটিক। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ছোটোগল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে, প্রকৃতির রং তুলি দিয়ে এক কিশোরের মানসিক যন্ত্রণাকে প্রতিবিম্বিত করেছেন।
প্রকৃতির সন্তান: প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তান ফটিক কলকাতায় মামা ও মামির আশ্রয়ে এসে প্রথম উপলব্ধি করে, নাগরিক জীবনে সে কতটা অবাঞ্ছিত। ফটিকের গ্রামে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা শুধু মায়ের জন্য নয়, তার অন্তরাত্মার সঙ্গে প্রকৃতির এক নিবিড় একাত্মতার কারণে। শিশুর শিক্ষালাভে যান্ত্রিক পরিবেশ যে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ, সেই মনোভাবই আশ্চর্য সহানুভূতির সঙ্গে গল্পকার এখানে উন্মোচিত করেছেন।
দলের নেতা: ‘ছুটি’ গল্পের নায়ক ফটিক তার দলবল নিয়ে উন্মুক্ত প্রকৃতির বুকে ছিল স্বচ্ছন্দবিহারী এক কিশোর। ঘুড়ি ওড়ানো, নদীতে সাঁতার কাটা, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ বলে ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে তার মন আনন্দরসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত।
সত্যের পূজারি: সত্যের পূজারি ফটিক তার ভাই মাখনলালের গালে চড় মেরে ভাইয়ের মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। কিন্তু অপরদিকে ভ্রাতৃস্নেহে আর্দ্র ফটিক কলকাতা যাত্রার পূর্বে খেলার ঘুড়ি, লাটাই, ছিপ ভাইকে সমর্পণ করে তা সম্পূর্ণ ভোগের অধিকার দিয়ে যায়।
অভিমানী: ফটিক ভীষণ অভিমানী। খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে মাখন যখন তাকে মেরে বাড়ি চলে গিয়েছে, তখন অভিমানে সে আনমনে বসে থেকেছে। মাখনের মিথ্যে অভিযোগে মা যখন তাকে প্রহার করেছে, সেই মুহূর্তে মৃদু প্রতিবাদ করলেও মায়ের উপর তার অভিমান হয়েছে। আপাত মাতৃস্নেহবিহীন গৃহ পরিবেশে উপেক্ষিত ফটিক তাই মামার প্রস্তাবে সহজেই কলকাতা যেতে রাজি হয়ে গিয়েছে। আবার কলকাতা গিয়ে মামির হৃদয়হীন আচরণে অভিমান করে সে বাড়ি ছেড়েছে। এই অভিমান থেকেই ক্রমে প্রাণোচ্ছল ফটিক নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে এবং শেষপর্যন্ত মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হয়েছে।
স্নেহকাতর: ফটিক স্নেহের কাঙাল। গল্পে দেখা যায়, পিতৃহীন ফটিক তার মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। সে বোঝে তার মায়ের হৃদয়ের অধিকাংশটাই জুড়ে রয়েছে ভাই মাখন। তাই মামা বিশ্বম্ভরবাবুর সস্নেহ প্রস্তাবে রাজি হয়ে সে কলকাতা চলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে মামির স্নেহহীন সান্নিধ্য তাকে পীড়িত করে। তাই স্নেহবুভুক্ষু ফটিক শেষপর্যন্ত মামারবাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যায় জর্জরিত: বয়ঃসন্ধিকালীন অবস্থায় নানা ব্যর্থতা কিশোর-কিশোরীদের অন্তরকে পীড়িত করে। ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের প্রতি মামির রূঢ় আচরণ, শিক্ষকের প্রহার, বই হারিয়ে ফেলা, বন্ধুত্বহীন নিঃসঙ্গ জীবন ইত্যাদি ঘটনার ফলে মানসিক দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত ফটিকের অন্তরাত্মা। বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বুঝতে না পারার অক্ষমতাই তাকে অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছে।
উপসংহার: আসলে রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য গল্পে ফটিকের জীবনে আলো ফেলে কিশোর মনের সমস্যার সংকটটিকে যেমন আলোকিত করতে চেয়েছেন, তেমনই দেখিয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে যার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছেদে তার বৌদ্ধিক মৃত্যু অনিবার্য। তবে, অনুভূতিশীল ফটিক মুমূর্ষু অবস্থাতেও উপলব্ধি করেছে তার ছুটি হয়েছে। রবীন্দ্রসাহিত্যে ‘ছুটি’-র ফটিক তাই একটি অনন্য চরিত্র হয়ে আজও জীবন্ত হয়ে আছে।