রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের মামির চরিত্র আলোচনা করো।
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামি চরিত্রটি কাহিনির করুণ পরিণতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গল্পে তাঁর উপস্থিতি খুব বেশি নয়। ফটিক যখন তার অবাধ-অগাধ স্বাধীনতা ছেড়ে মামার সঙ্গে কলকাতা এসেছে, তখনই পাঠক প্রথম পরিচিত হয়েছে এই হৃদয়হীন মামির সঙ্গে। ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালীন মর্মব্যথাকে আরও দুঃসহ করে তোলার ক্ষেত্রে এই মামির ভূমিকা অপরিসীম।
বিরূপ মনোভাবাপন্ন: প্রথমেই দেখা গিয়েছে স্বামীর সিদ্ধান্তকে তিনি ভালো মনে গ্রহণ করেননি। বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে নিজদায়িত্বে কলকাতায় নিয়ে এলে ফটিকের মামি তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। ফটিকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, ফটিকের আগমনে তিনি খুশি নন। ফটিককে সাদর সম্ভাষণ জানানো তো দূরের কথা, সামান্য প্রীতি বা সৌহার্দ্য বিনিময় করতেও দেখা যায়নি তাঁকে।
হৃদয়হীন-নিষ্ঠুর আচরণ: গল্পে জানা যায়, তাঁর মামি তিন সন্তানকে নিয়ে নিজের নিয়মে সংসার পরিচালনা করেন। তাই একটি তেরো-চোদ্দো বছর বয়সি অপরিণত, অশিক্ষিত গ্রামের ছেলেকে তাঁর গ্রহণ করতে অসুবিধা হয়েছে। বিশ্বম্ভরবাবুর সিদ্ধান্তকে বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও কখনোই ফটিকের সঙ্গে তিনি স্নেহপূর্ণ আচরণ করেননি। বরং তাঁর হৃদয়হীন সান্নিধ্যই ফটিককে ঠেলে দিয়েছে গভীর অবসাদে। মামির কাছে নিজেকে দুর্গ্রহ মনে হয়েছে ফটিকের। শরীর খারাপ হলে মামির সংসারে নিজেকে উপদ্রব বলে মনে করেছে সে। তাই বাড়ি ছেড়েছে ফটিক। ফটিকের বাড়ি ছাড়ার পিছনে মামির এই হৃদয়হীনতা অনেকখানি দায়ী।
মমতাহীন মাতৃত্ব: মামির তিনটি সন্তান থাকলেও ফটিকের প্রতি তাঁর মমত্ব বা মাতৃত্ববোধের লেশমাত্র প্রকট হতে দেখা যায়নি। ফটিক মামির কাছে মাতৃস্নেহে প্রতিপালিত হতে পারত কিন্তু মামির কাছে তার প্রাপ্তি ছিল চরম অপমান।
প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা এই অসংস্কৃত বালক ফটিকের স্নেহপ্রত্যাশী মনকে মামি অবদমিত করেছেন, তার উৎসাহকেও প্রতিমুহূর্তে দমিয়ে রেখেছেন তিনি। এমনকি, ফটিক অসুস্থ হয়ে পড়লেও মামির মধ্যে কোনও তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। গল্পে ফটিকের মর্মান্তিক পরিণতিতে মামির বড়ো ভূমিকার কথা অনুভূতিশীল পাঠকমাত্রই অনুভব করতে পারেন।
বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যায় অনুঘটক: ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যায় অনুঘটকের কাজ করেছেন মামি। ফটিক তাঁর ননদের ছেলে, সন্তানতুল্য। কিন্তু মামির কাছ থেকে পাওয়া অপমান, উপেক্ষা ও স্নেহবঞ্চনা ফটিকের অন্তরকে পীড়িত করেছে। ফটিকের অসুস্থতায় মামির প্রতিক্রিয়া-“পরের ছেলেকে নিয়ে কেন এ কর্মভোগ।” এই ঘটনাগুলি ফটিকের মনের মধ্যে – অপরাধবোধের মাত্রাকে তীব্রতর করেছে। এর পরেই এই মুক্তিপিপাসু বালক – বিশ্বপ্রকৃতির অনন্ত রহস্যের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছে।
উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ এমনই এক স্বার্থান্বেষী মামির চরিত্রকে গড়ে তুলেছেন যা ফটিককে তার মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে দিয়েছে।