রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্প অবলম্বনে বিশ্বম্ভরবাবুর চরিত্রটির পরিচয় দাও।
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র তথা নায়ক ফটিক চক্রবর্তীর মামা বিশ্বম্ভরবাবু। গল্পের শুরুতেই একটি মজাদার খেলা আবিষ্কার করেও যখন মাখনের দুষ্ট জেদের কারণে খেলা ভঙ্গ হয়ে যায়, তখন ফটিক উদাস হয়ে নদীঘাটে একটি অর্ধনিমগ্ন নৌকার গলুইয়ের উপর বসে থাকে। সেইসময় একটি বিদেশি নৌকায় এক অপরিচিত ব্যক্তির আগমন ঘটে। পরে জানা যায় তিনিই বিশ্বম্ভরবাবু। গল্পকার প্রথমেই জানিয়ে দেন বিশ্বম্ভরবাবু মাঝবয়সি। তাঁর চুলগুলি পাকা হলেও গোঁফ কাঁচা। তিনি নদীঘাটে ফটিকের কাছে চক্রবর্তীদের বাড়ির ঠিকানা জানতে চান এবং ফটিকের ইশারায় সঠিক দিশা না পেয়ে চলে যান। বাড়িতে যখন ফটিক-মাখন-মায়ের বিবাদ তুঙ্গে, ঠিক তখনই সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বিশ্বম্ভরবাবু প্রবেশ করেন এবং বলেন, ‘কী হচ্ছে তোমাদের!’ বিবাদ সেই সময়ের জন্য থামে। জানা যায়, বিশ্বম্ভরবাবু পশ্চিমে কাজ করতে গিয়েছিলেন অনেকদিন। দেশে ফিরে বোনের খবর নিতে এসেছেন।
স্নেহশীল: বিশ্বম্ভরবাবু বোনের প্রতি যেমন ছিলেন স্নেহপরায়ণ তেমনই তিনি সংবেদনশীল এক মানবিক চরিত্র। তিনি পশ্চিমে কর্মে লিপ্ত ছিলেন বলে বোনের পতি বিয়োগের সময় আসতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই স্নেহের আকর্ষণে বোনকে দেখতে আসেন।
কর্তব্যপরায়ণ: বিশ্বম্ভরবাবুর এই আগমনে তাঁর দায়িত্ববোধ তথা কর্তব্যপরায়ণতার দিকটি খেয়াল করা যায়। তিনি বোনের সঙ্গে কথা বলে ভাগনেদের পড়াশোনা এবং মানসিক উন্নতির কথা জানতে চান। ফটিকের উচ্ছৃঙ্খলতা ও পড়াশোনায় অমনোযোগের কথা শুনে এবং বিধবা বোনের অসহায়তা বুঝে ফটিককে কলকাতায় নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন।
অবিবেচক: ফটিক কলকাতার নাগরিক পরিবেশে থাকাকালীন যে দুঃসহ ব্যথা অন্তরে বহন করেছিল, তার শরিক হতে পারেননি বিশ্বম্ভরবাবু। স্নেহ, মায়া, মমতা ও সহানুভূতির বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ফটিকের জন্য তিনি তার সহৃদয়তারও কোনো পরিচয় দেননি। এমনকি ফটিকের মামির নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদ না করে তিনি নীরব দর্শক হয়েই থেকেছেন।
বাস্তবজ্ঞানহীন: বিশ্বম্ভরবাবু ছিলেন এক বাস্তববোধহীন মানুষ। কারণ তাঁর নিজের তিনটি সন্তান থাকা সত্ত্বেও ভাগনে ফটিকের শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্ব নিয়ে তিনি সংসারে এক মহাসংকট ডেকে আনেন। বিশ্বম্ভরবাবুর বাস্তবজ্ঞানহীনতার জন্যই কার্যত সহজসরল, মুক্ত প্রকৃতির লালিত সন্তান ফটিককে জীবনাহুতি দিতে হয়েছে।
মানবদরদি: গল্পের শেষে বিশ্বম্ভরবাবুকে আবার মানবিক হতে দেখা যায়। ফটিক বাড়ি থেকে পলায়ন করলে তিনি পুলিশকে খবর দেন। অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ ফটিককে ধরে আনলে তিনি তাকে কোলে করে অন্তঃপুরে নিয়ে যান। ফটিকের জ্বর বাড়লে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ডাক্তার ডাকেন এবং ফটিকের মাকে আনতে পাঠান। গল্পে তিনি যেটুকু উপস্থিত থেকেছেন, তাতে তাঁর কর্তব্যপরায়ণতা, স্নেহশীলতা যেমন প্রকাশিত হয়েছে তেমনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর মানবিক হৃদয়বৃত্তিগুলিও।
উপসংহার: সবশেষে বলা যায় যে, ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবুর চরিত্রটি যাবতীয় মানবিক গুণসম্পন্ন হয়েও ফটিকের জীবনকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে এক ব্যর্থ কারিগররূপেই চিত্রিত হয়েছে।