রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে চিত্রিত ফটিকের মায়ের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো

রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে চিত্রিত ফটিকের মায়ের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের গড়ে ওঠা ও করুণ পরিণতির নেপথ্যে গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার মায়ের চরিত্রটি। এই গল্পে মা খুব স্বল্পপরিসরজুড়ে থাকলেও ফটিক চরিত্রটিকে অবলম্বন করে গল্পের সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছেন। ফটিকের কলকাতা যাত্রার পূর্বে ও পরবর্তীতে মায়ের চরিত্রটিকে দু-বার এই গল্পে আবিষ্কার করা যায়। যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ‘ছুটি’ গল্পে ‘ফটিকের মা’ চরিত্রটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে, সেগুলি নিম্নরূপ-

আত্মনির্ভরশীল: ফটিকের মা একজন বিধবা একাকী রমণী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দুই ছেলে, মাখন ও ফটিককে একার প্রচেষ্টায় বড়ো করতে দেখা গিয়েছে। লক্ষণীয়, তিনি কিন্তু কারোর সাহায্যপ্রার্থী হননি। দীর্ঘদিন যোগাযোগবিচ্ছিন্ন দাদা বিশ্বম্ভর হঠাৎই বোনের বাড়ি এসে উপস্থিত হলে বোনের দুরবস্থার কথা জানতে পারেন। বিধবা মা আত্মনির্ভরশীলতার জোরেই দুই সন্তানকে একা সামলেছেন।

সন্তানদের ভবিষ্যৎচিন্তায় সদাতৎপর: ফটিকের মা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বদা সচেতন ছিলেন। তিনি দুই ছেলেকেই লেখাপড়া শেখাতে আগ্রহী। দাদা বিশ্বম্ভরের কাছে তিনি কনিষ্ঠ পুত্র মাখনলালের বিদ্যানুরাগ নিয়ে প্রশংসা করেন। ফটিকের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত ও নিরাপদ করতেই একবাক্যে তাকে কলকাতায় পাঠাতে রাজি হয়ে যান। সন্তানদের শুভকামনায় সর্বদা তাঁকে বিচলিত হতে দেখা গিয়েছে।

কঠিনে-কোমলে: দুই সন্তান এবং সর্বোপরি ফটিকের মতো দুরন্ত এক ছেলেকে সামলাতে গিয়ে মাকে প্রয়োজনে কঠোর হতে ও শাসন করতে দেখা গিয়েছে। মাখনের কথায় বিশ্বাস করে ফটিককে প্রহার করার বিষয়টি আপাতভাবে তাঁর নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী রূপ বলে মনে হলেও তাঁর অপত্যস্নেহের দিকটিও বিচার্য। ফটিকের দৌরাত্ম্যে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে তাকে প্রহার করেন, কারণ সেই মুহূর্তে ফটিককে শাসন করাই তাঁর উচিত বলে মনে হয়েছিল। আবার, ফটিক মামার কথায় কলকাতা যাত্রার ব্যাপারে সহজেই স্বীকৃত হলে মাকে মনঃক্ষুণ্ণ হতেও দেখা যায়।

ফটিকের মা: গল্পে মা চরিত্রটিকে মাখনের প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীল ও ফটিকের প্রতি রুষ্ট হতে দেখা গেলেও গল্পে রবীন্দ্রনাথ এই চরিত্রটিকে আদ্যন্ত ‘ফটিকের মা’ বলেই নির্দেশ করেছেন। দুরন্ত ছেলেটির প্রতি মায়ের পরোক্ষ অথচ অধিকতর উদ্বেগকেই এখানে দেখাতে চেয়েছেন গল্পকার। মাখনকে কোনোদিন ফটিক জলে ফেলে দিতে পারে বা গুরুতরভাবে আঘাত করতে পারে- এই বিষয়ে ‘ফটিকের মা’-র আশঙ্কা থাকায় তিনি দাদা বিশ্বম্ভরের সঙ্গে তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দিতে চান। উল্লেখ্য, দাদা বিশ্বম্ভরকে তিনি যথেষ্ট ভরসা করতেন, তাই সুরক্ষিত হাতেই তিনি ফটিককে অর্পণ করেছেন। ফটিকের শুভচিন্তা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বার্থেই তাকে দূরে পাঠাতে কুণ্ঠিত হয়নি এই মাতৃহৃদয়, তথাপি ফটিক একবাক্যে শহরে যেতে রাজি হয়ে গেলে তিনি কষ্টই পান। অর্থাৎ ছেলে, মায়ের কাছে থেকে যাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ না করে স্বেচ্ছায় তার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে-যা এই স্নেহময়ী মা সহজে মেনে নিতে পারেননি।

আবার দেখা যায়, রোগশয্যায় ফটিক মায়ের কাছেই যেতে চেয়েছে, বয়ঃসন্ধির টানাপোড়েনেও তার মা-ই হতে পারতেন আশ্রয়। অর্থাৎ নাগরিক জীবন থেকে মাকেই মুক্তির অবলম্বন করতে চেয়েছে সে এবং শেষেও মাকেই সে বলে-“মা, আমার ছুটি হয়েছে মা” অর্থাৎ মা-ই ফটিক ও প্রকৃতির এক যোগসূত্র হয়ে উঠেছে। অবাধ্য, দুষ্ট সন্তানটিকে আপাতচক্ষে মায়ের উপদ্রব বলে মনে হলেও সে-ই মায়ের অন্তরের সবচেয়ে কাছের ধন। আর মায়ের এই ভালোবাসা ঘোষিত হয়েছে ‘ফটিকের মা’ সম্বোধনের মধ্য দিয়েই।

উপসংহার: উল্লেখ্য, ফটিক নগরে চলে গেলে মায়ের জন্য তার মন বারবার কেঁদে ওঠার কথা গল্পে আছে কিন্তু একই সময়ে মায়ের মনোভাব গল্পে ব্যক্ত হয়নি। কেবল গল্পের শেষপ্রান্তে এসে ফটিকের অসুস্থতার খবর শুনে শোকাতুর হয়ে তাঁর আগমনের ছবিটুকুই পাওয়া যায়। ফটিক তাঁর ছুটি হওয়ার তথা মুক্তি পাওয়ার ভাবটি মাকেই প্রথম বলে, অর্থাৎ মা ও ফটিকের হৃদয়ের যোগ ছিলই, কিন্তু ফটিক চরিত্রটিকে স্পষ্ট করে তুলতে মায়ের চরিত্রটি আড়ালেই থেকে গিয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, ফটিকের মা-এর আপাতকঠোর, নিষ্ঠুর, অত্যাচারী প্রতিকৃতির আড়ালে একজন স্নেহময়ী, শুভাকাঙ্ক্ষী, কর্তব্যপরায়ণ, সন্তানের চিন্তায় মগ্ন মাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

Leave a Comment