হারুন সালেমের মাসি গল্পের গৌরবি চরিত্রটি আলোচনা করো

হারুন সালেমের মাসি গল্পের গৌরবি চরিত্রটি আলোচনা করো।

ভূমিকা: মহাশ্বেতা দেবী রচিত ‘হারুন সালেমের মাসি’ ছোটোগল্পের প্রধান তথা কেন্দ্রীয় চরিত্র গৌরবি। গল্পকার আলোচ্য গল্পে নিজস্ব লিখনশৈলীর গুণে মাতৃহৃদয়ের আত্মিক টানকে তুলে ধরেছেন গৌরবি চরিত্রের মধ্য দিয়ে।

বন্ধুত্বসুলভ মানসিকতা: জন্ম থেকে গৌরবির একটা পায়ে খুঁতের কারণে জীবিকা অর্জনে সে অক্ষম। তাই দীনদুঃখী অসহায় বিধবা গৌরবি তার প্রতিবেশী হারার মা আয়েছা বিবির দেখানো উপার্জনের পথেই এগিয়েছে। শুধু তাই নয়, দুজনের মধ্যে একটা মনের মিলও তৈরি হয়েছে- ফলত উভয়কেই একসঙ্গে রোজ সকালে খালপাড়ে, বিলের ধারে শাকপাতা গুগলি ইত্যাদি সংগ্রহ করতে এবং সেগুলি হাটুরে যশি ওরফে যশোদার মারফত শহরের বাজারে বিক্রি করিয়ে পয়সা রোজগার করতে দেখা গিয়েছে আর সেই আয় দিয়ে গৌরবির রোজকার দিন চলেছে কোনোরকমে। একদা আয়েছ। বিবিকে রমজান মাস পালন করতে দেখে গৌরবি জানতে পেরেছে যে তাদের ধর্ম আলাদা তবু ধর্মপরিচয় তাদের বন্ধুত্বে ছেদ ফেলেনি বরং কাজের অবসরে হারার মা গৌরবির উঠোনে বসে গৌরবির মাথার উকুন বেছেছে আবার দুজনে একই সঙ্গে হাটুরেদের বাজার ফেরত ফেলে যাওয়া বাঁধাকপির বুড়ো পাতা, থেতলে যাওয়া বিলিতি বেগুন কুড়িয়েছে। দুজনের সমাজ আলাদা হলেও তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে হৃদ্যতা, তৈরি হয়েছে সখ্য। গৌরবির মনের ধর্মীয় সংস্কার কখনোই তার আর হারার মায়ের বন্ধুত্বের উপর প্রকট হয়ে চেপে বসেনি।

উদার ও সংস্কারমুক্ত মানসিকতা : ছেলে নিবারণ গৌরবিকে ভাত দিতে অস্বীকার করলেও ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে ভাত আদায় করতে যায়নি সে। আবার ছেলেমেয়েকে গালমন্দও করেনি। বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে সেই অনুযায়ীই নিজের জীবনকে পরিচালিত করেছে গৌরবি। হারার মায়ের জাতধর্ম তো দূরে থাক, নামটা পর্যন্ত বহুদিন জানত না গৌরবি। রমজানের মাসে হারার মাকে রোজা রাখতে দেখে বুঝেছিল তাদের সমাজ আর গৌরবির সমাজ আলাদা- কিন্তু তাতে গৌরবির আচরণে বা মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি, গৌরবির কাছে ব্যবহারই মানুষের আসল পরিচয়। আয়েছা বিবি আর হারাকে তাই তার আপনজন বলেই মনে হয়েছে। জীবনের সারবস্তু সে বুঝেছে- যে সব গরিবের স্বর্গ আসলে এক। গ্রামের মেয়ে, গ্রামের বউ গৌরবির মনে সুবিশাল সমুদ্রের উদারতা, সেখানে কেবল মাতৃস্নেহ, মানবিকতা ও স্বার্থশূন্য ভালোবাসার ঢেউ ওঠে। গৌরবির পেটে খিদের আগুন জ্বললেও হৃদয়ে জ্বলে সহানুভূতির প্রদীপ। তবে সমাজের অন্দরে গেঁথে যাওয়া সাম্প্রদায়িক বৈষম্য যে গৌরবির মনেও ছুৎমার্গ বা একঘরে হওয়ার ভয় সৃষ্টি করেনি তা নয়, কিন্তু সকল ভয়কে জয় করেই হারাকে নিজের উঠোনে স্থান দিয়েছিল গৌরবি।

মানসিক দৃঢ়তা: যশির কাছ থেকে হারার ব্যাপারে পরামর্শ নিলেও শহরের ফুটপাথে হারাকে মরতে পাঠায়নি গৌরবি। যশির বাঁকা কথার বিষ নিঃশব্দে গিলে নিয়েছে সে। সাত বছরের অনাথ ছেলেটিকে অজানা অচেনা পথে মরতে পাঠানোর মতো অমানবিক নয় গৌরবি। বরং হারাকে শহরে ছেড়ে এলে নিবারণের বাড়িতে আশ্রয় পাওয়ার যে সুবর্ণ সুযোগ গৌরবি পেতে পারত সেটিও অবলীলায় ত্যাগ করেছে সে।

গৌরবির পা খোঁড়া তবে তার ভাবনা পঙ্গু নয়। অদ্ভুত এক দৃঢ় চেতনায় গৌরবি ক্রমশ ধর্মনিরপেক্ষতার সার্থক প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পেরেছে। মাতৃহারা অনাথ হারার বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের বেলায় কেবল নিজের মনের কথা নিজের হৃদয়ের ডাকই শুনেছে গৌরবি।

মানবিক সিদ্ধান্ত: শুধুমাত্র সাত বছরের অনাথ হারাকে বাঁচানোর তাগিদে গৌরবি রাতের অন্ধকারে তাকে নিয়েই শহরের উদ্দেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ায়। গৌরবি শহরের ব্যস্ততম রাজপথে ভিক্ষে করে হারাকে বাঁচাবে, যেখানে কেউ তাদের জাতধর্ম জিজ্ঞেস করবে না। জাতধর্মের নিরিখে নয়, এভাবেই মানবিকতার পবিত্র সুতোর বন্ধনে হারার সঙ্গে নিজেকে বেঁধে নেয় গৌরবি।

মা থেকে মাসি: গৌরবি জাতধর্ম ত্যাগ করে, পিছুটান ভুলে মনপ্রাণ দিয়ে কেবলই ‘হারুন সালেমের মাসি’ হয়ে উঠতে চেয়েছে। গৌরবি আসলে বিধর্মী এক মাতৃহারা বালকের মায়ের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। অধসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে সমুচিত শিক্ষা দিয়ে গৌরবি সব সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং প্রমাণ করেছে মায়ের কোনো জাত হয় না। নিবারণের মা গৌরবির এই হারুন সালেমের মাসি হয়ে ওঠার যাত্রা আসলে তার নিজের আত্মপরিচয় অর্জনের যাত্রা, তার স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার যাত্রা।

Leave a Comment