শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়ার অবদান আলোচনা করো | Begum Rokeya’s contribution to education and social reform

শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়ার অবদান – বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের একজন স্বনামধন্যা নারী অধিকারের প্রবক্তা হলেন বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার পুরোনাম ছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা বিশিষ্ট বাঙালি লেখিকা, সমাজকর্মী ও নারীবাদী ঔপন্যাসিক। তিনি তৎকালীন সময়ে ঐতিহ্যবাহী পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বহু পত্র-পত্রিকায় নারীমুক্তি ও ক্ষমতায়নের বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। নারীশিক্ষা, স্বাধীনতা এবং নারীদের আত্মপ্রকাশের অধিকারের পক্ষে লড়াই করেছেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সংস্কার ও নারী অধিকার প্রচারের জন্য সংগ্রাম করেছেন।

শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়ার অবদান

শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়ার অবদান আলোচনা করো
শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়ার অবদান আলোচনা করো

বেগম রোকেয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনী

1880 খ্রিস্টাব্দের ও ডিসেম্বর ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের (বর্তমানে বাংলাদেশ) পায়রাবন্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ও মাতার নাম ছিল যথাক্রমে জাহিরউদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলি হায়দার সাবের এবং রাহাতুন্নেসা খাতুন। শৈশবে রোকেয়া বাড়িতেই তার বড়ো দাদার কাছে বাংলা ও আরবি শিখেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ থাকলেও তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী তাকে প্রথাগত কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভরতি করা হয়নি। কিন্তু মেধা কখনও চাপা থাকে না। বাড়িতে বড়োদের কাছ থেকে তিনি পাঠ গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তার বড়ো ভাইয়ের সহযোগিতায় রোকেয়া সমাজের সীমাবদ্ধতাগুলিকে অতিক্রম করে একটি স্কুলে ভরতি হয়েছিলেন এবং পড়াশোনা চালিয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে, বেগম রোকেয়া তাঁর স্বামী খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের প্রচেষ্টায় এবং সহযোগিতায় 1909 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বাঙালি মুসলিম মেয়েদের জন্য একটি বালিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর মৃত স্বামীর নাম অনুসারে বিদ্যালয়টির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল’। রোকেয়া আরও অনেকগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, নারী অধিকার খর্ব করা, সামাজিক অবিচার প্রভৃতির বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। সাহিত্যসৃষ্টিতে তাঁর অবদান তৎকালে সমাদৃত ছিল। তিনি 1932 খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।

বেগম রোকেয়ার অবদান

বেগম রোকেয়ার অবদানকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়- নারী শিক্ষার বিকাশ,  সাহিত্যসৃষ্টি এবং  সমাজসংস্কার।

(1) নারীশিক্ষার বিকাশ:

রোকেয়া ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা নারী। তিনি এমন একটি নারীসমাজের কল্পনা করেছিলেন যেখানে নারীকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে হয় নারীরা এগিয়ে থাকবে অথবা পুরুষদের সাথে একভাবে চলবে। শুধু নারী হিসেবে অর্থাৎ কন্যা সন্তান হিসেবে জন্ম নেওয়ার কারণে তাদের বিদ্যালয় শিক্ষায় অগ্রসর হতে দেওয়া হবে না, বাড়িতে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করা শর্তেও মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ে তাদের পাঠানো যাবে না-এইসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বেগম রেকোয়া। তিনি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা জনমানসের কাছে তাঁর লেখার মাধ্যমে তুলে ধরা চেষ্টা করেন। একটি পাখি কেবল একটি ডানায় ভর দিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে পারে না।

নারী শিক্ষার বিকাশ না ঘটলে শুধু শিক্ষিত পুরষদের দিয়ে দেশকে অগ্রগতির পথে বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়-এই বার্তা সমাজের কাছে তুলে ধরেছিলেন। জীবনের প্রতিটি ধাপে নারীকে দমিয়ে রাখা যাবে না, বরং নারীরা শিক্ষিত হলে, তাঁদের সন্তানরা আরও বেশি শিক্ষিত হবে। সমাজ অগ্রগতির পথে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে, এটি প্রচার করেন। লিঙ্গবৈষম্য নয়, নারীদের অধিকার খর্ব করা নয়, শিক্ষা অঙ্গন থেকে নারীদের দূরে রাখা নয়-চাই নারীদের স্বাধীনতা, চাই পুরুষের ন্যায় শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের সমান সুযোগসুবিধা এবং নারী শিক্ষার পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা।

নারীশিক্ষার বিষয়ে রোকেয়ার আন্দোলন বা সংগ্রাম শুধু সাহিত্য-পত্রিকায় লেখা হিসেবেই থেমে থাকেনি। তিনি সরাসরি বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হন। তাঁর প্রচেষ্টায় কয়েকটি স্কুল এবং কলেজ স্থাপিত হয়। তিনি আজীবন নারীদের জন্য শিক্ষার সুযোগসুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে সক্রিয় ছিলেন। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ন্যায়বিচার ও নারী অধিকার প্রচারের জন্য ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’ (ইসলামি মহিলা সমিতি) নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তাঁর লেখাগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভাবনাকে তুলে ধরে। নারী শিক্ষার বিষয়ে তাঁর মূল কাজগুলি হল-[i] নারীশিক্ষার প্রসার, [ii] নারী সমাজের সংস্কারমূলক ক্রিয়াদি, [iii] নারীদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, [iv] নারীর অধিকার বিষয়ে সচেতনতা কর্মসূচি আয়োজন, [v] নারীশিক্ষা ও তার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য সংস্থা গঠন ইত্যাদি।

(2) সাহিত্য সৃষ্টি: 

বেগম রোকেয়া তাঁর রচনার মাধ্যমে সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। এখানে তাঁর লেখা কয়েকটি উপন্যাস, ছোটোগল্প বিষয়ে আলোকপাত করা হল।

  1. উপন্যাস ও ছোটোগল্প: রোকেয়া অনেকগুলি উপন্যাস ও ছোটোগল্প রচনা করেছেন। ওই সকল লেখা তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে আলোকপাত করে। তাঁর লেখাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী অধিকার ও শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়গুলি স্থান পায়। শুধু তা-ই নয়, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের বঞ্চনা করুণ পরিস্থিতি পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত হয়। লেখিকা সর্বদাই নারী ক্ষমতায়নের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং পুরুষদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করেন। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল-‘পদ্মরাগ’, ‘মতিচুড়’ এবং ‘সুলতানার স্বপ্ন’।
  2. সুলতানার স্বপ্ন: রোকেয়ার অনবদ্য সৃষ্টি হল ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসটি। এটি 1905 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি ‘লেডিল্যান্ড’ নামে একটি ইউটোপিয়ান পৃথিবীর ভাবনাকে তুলে ধরে। যে পৃথিবীতে মহিলারাই সকল ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় থাকে এবং পুরুষরা গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকে। এই সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যমে রোকেয়া ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গ ভূমিকাকে কটাক্ষ ও চ্যালেঞ্জ জানান এবং এমন একটি বিশ্বের বা সমাজ ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন যেখানে নারীদের প্রাধান্য এবং স্বাধীনতাকে বিশেষভাবে স্বীকার করা হয়।
  3. নারীবাদী চিন্তাধারা: রোকেয়ার সাহিত্যে শক্তিশালী নারীবাদী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি মহিলাদের শিক্ষা, সমতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সরব হয়েছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন এবং বৈষম্য দেখলেই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন ও তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় নারীদেরকে যেভাবে বঞ্চনা করা হত, নারীরা যেসকল সামাজিক বাধার ও বৈষম্যের মুখোমুখি হত, সেগুলিকে তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন এবং ওই সকল সামাজিক সমস্যার দ্রুত সমাধানের বিষয়ে সরব হয়েছেন। তাঁর লেখাগুলি বাঙালি সমাজের লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক আলোচনাকে উৎসাহিত করেছে।
  4. ছদ্মনামের ব্যবহার: রোকেয়া তাঁর রচনাগুলি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশের সময় সরাসরি নিজের নাম ব্যবহার না করে, ছদ্মনামে প্রকাশ করতেন। তাঁর ছদ্মনাম হল-‘চোখের বালি’ এবং ‘মিসেস আর এস হোসেন’। এই ছদ্মনাম তাঁকে তাঁর বক্তব্য ও ধারণাগুলিকে সমাজের কাছে অবাধে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা দান করেছে। ছদ্মনামের ব্যবহারের ফলে তাঁকে খুব বেশি প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়নি। অথচ সমাজের প্রচলিত দুর্নীতিগুলির বিরুদ্ধে তিনি সহজে প্রতিবাদ জানাতে পেরেছেন।
  5. সাহিত্যের মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পক্ষে ওকালতি: রোকেয়া গল্প বলার মাধ্যমে, তাঁর সাহিত্য মন্ত্রকে সমাজ সংস্কারের কাজে ব্যবহার করেছেন। তাঁর লেখাগুলি নারীশিক্ষা, নারীদের অধিকারের জন্য আলাপ- আলোচনা ও আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল, যা বিংশ শতাব্দীর সূচনাতে বাংলায় ঘটে যাওয়া বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনে সহায়তা করেছিল।
  6. সাংস্কৃতিক প্রভাব সৃষ্টিতে অবদান: রোকেয়ার সাহিত্যগুলি তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবে আজও সমাদৃত হয়। সাহিত্য যে সমাজের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করে এবং সমাজ সংস্কারে ভূমিকা পালন করে, তাঁর লেখার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা অত্যুক্তি নয়।

(3) সমাজসংস্কার: 

নারী শিক্ষাবিমুখতা এবং অন্যায় ও অবিচারের প্রতি সহমর্মিতা মানবতাবাদী লেখিকা ও সমাজসেবিকা বেগম রোকেয়ার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নারীর অশিক্ষা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য এবং নারী শিক্ষার বিকাশের জন্য তিনি যা করেছিলেন তা তাঁকে আমাদের দেশের অন্যতম একজন বিশিষ্ট সমাজসংস্কারকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। সমাজ সংস্কারের জন্য তিনি যে সকল কাজ করেছিলেন সেগুলি এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-

  1. নারী শিক্ষার পক্ষে মতামত দান ও কাজ: বেগম রোকেয়া যে সময়কালে নারী শিক্ষার জন্য কাজ করেছিলেন, সেই সময় সমাজে মহিলাদের বা কন্যা সন্তানদের বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা গ্রহণ করা একটি অস্বাভাবিক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হত। তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য 1909 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল স্থাপন করেন এবং সেখানে শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন।
  2. নারীদের ক্ষমতায়নে ভূমিকা পালন: রোকেয়ার লেখনি এবং বক্তৃতা মহিলাদের আত্মোন্নয়ন, স্বাধীনতা ও পুরুষদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মহিলাদের ক্ষমতায়নের মূল চাবিকাঠি হল শিক্ষা। শিক্ষার বিকাশ ঘটলে, অর্থাৎ নারীরা শিক্ষিত হলে তারা একদিকে যেমন অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতে পারবে, তেমনই পুরুষশাসিত সমাজে নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বজায় রাখতে সমর্থ হবে। শিক্ষিত হলে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ পাবে, অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হবে এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে।
  3. আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম প্রতিষ্ঠা: সমাজসংস্কার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বেগম রোকেয়া 1916 খ্রিস্টাব্দে একটি ইসলামি মহিলা সমিতি গঠন করেন। এর নাম রাখা হয় ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’। এই সমিতিটি রোকেয়ার নির্দেশমতো নারীশিক্ষা প্রসারে, স্বাস্থ্য সেবায় এবং আইনি অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করতে থাকে।
  4. পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতির সমালোচনা: রোকেয়া তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় পিতৃতান্ত্রিক কতকগুলি রীতিনীতির সমালোচনা করেছিলেন। পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার থাকবে-এ বিষয়ে আন্দোলন শানিত করেছিলেন। নারীর অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারিবারিক আইন ও রীতিনীতি সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাঙালি সমাজে নারীকে নিপীড়িত করা, এই বিষয়টির বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্য সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। তিনি তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
  5. ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা: একজন স্বনামধন্য সমাজসংস্কারক হিসেবে বেগম রোকেয়ার উত্তরাধিকার, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিভিন্ন সমাজ সংস্কারে উদ্যোগী কর্মী, সমাজসেবী, নারীবাদী আন্দোলনকারী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তাঁর অবদান দক্ষিণ এশিয়ার নারী অধিকার আন্দোলনের ভিতকে আরও বেশি মজবুত করেছে। শুধু তাই নয়, তাঁর লিঙ্গসমতা ও সামাজিক ন্যায় বিচার সম্পর্কিত আন্দোলন সারা বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
  6. সাহিত্যিক অবদান: গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও বক্তৃতা-সহ বিভিন্ন লেখার মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া লিঙ্গবৈষম্য, নারী অধিকার এবং সামাজিক অন্যায় বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি কল্পলৌকিক জগতের উপস্থাপনা করেছিল, যেখানে নারীরা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিল, প্রচলিত লিঙ্গ ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন এবং নারী নেতৃত্বের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছিল।

প্রধান অবদান

(1) শিক্ষামূলক উদ্যোগ: 

আনজুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম সংগঠনটি মেয়েদের জন্য অনেকগুলি স্কুল স্থাপন করে যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক বিষয়সমূহও পড়ানো হত। এই স্কুলগুলির মাধ্যমে মেয়েরা প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিল।

(2) পেশাগত প্রশিক্ষণ: 

সংগঠনটি মহিলাদের জন্য বিভিন্ন পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। সূচিকর্ম, দরজি কাজ এবং অন্যান্য কারুশিল্পের প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাঁরা মহিলাদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করে। এর ফলে মহিলারা তাদের নিজস্ব জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয়েছিল।

(3) সামাজিক সচেতনতা: 

আনজুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের পক্ষে প্রচার চালায়। তাঁরা বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা এবং নারীর অধিকার লঙ্ঘনকারী অন্যান্য সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলে। তাঁরা সমাজে নারীদের অধিকারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করে।

(4) স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি: 

আনজুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম মহিলাদের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কাজ করেছে। তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং মহিলাদের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত কর্মশালা এবং সেমিনার আয়োজন করে তারা মহিলাদের সুস্থ জীবনযাপনের জন্য উৎসাহিত করে।

(5) নারী নেতৃত্বের বিকাশ: 

আনজুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম নারীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের জন্য কাজ করেছে। সংগঠনটি মহিলাদের জন্য বিভিন্ন সাংগঠনিক দক্ষতা, যেমন-বক্তৃতা, প্রশাসনিক কাজ এবং নেতৃত্বের কৌশল শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এর ফলে মহিলারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে।

প্রভাব

আনজুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম নারীদের শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সংগঠনের প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে। তাদের কাজের মাধ্যমে, নারীরা আজ আরও সাহসী এবং সচেতন হয়ে উঠেছে এবং তাদের নিজস্ব অধিকারের জন্য লড়াই করতে সক্ষম হয়েছে।

বেগম রোকেয়ার কার্যাবলির মূল্যায়ন

(1) নারী শিক্ষা ও সাক্ষরতার প্রসার: 

নারী শিক্ষা ও সাক্ষরতা প্রসারের ক্ষেত্রে রোকেয়া বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। মুসলিম নারীদের প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষায় অবতরণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কম নয়। পরিবারে নারীদের যেভাবে অবহেলা করা হত, আজ আর তা করা হয় না। এই সকল ক্ষেত্রে কিছু হলেও রোকেয়ার অবদান আছে।

(2) লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা: 

নারীদের সমান অধিকার বিষয়ে এবং পরিবারে নারী ও পুরুষ উভয় সদস্যদের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রোকেয়ার অবদান রয়েছে। নারী স্বাধীনতা ও সমান অধিকার আজ আমাদের সমাজকে অনেকখানি প্রগতির জায়গায় নিয়ে এসেছে। এর পেছনে রোকেয়ার অবদান রয়েছে, এটি অস্বীকার করা যায় না।

(3) সমাজ সংস্কারে ভূমিকা: 

বেগম রোকেয়া একজন প্রথিতযশা সমাজসংস্করক হিসেবে বিবেচিত হন। কুসংস্কার মুক্ত নারী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা এককথায় অনস্বীকার্য। তিনি যেমন নারীদের শিক্ষা সংস্কারের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়েছিলেন, নারী শিক্ষা বিকাশের জন্য শিক্ষাদান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, তেমনি স্বাস্থ্য সেবা ও নারীদের আইনি অধিকারের বিষয়গুলি জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্যও সহায়তা দানে সচেষ্ট ছিলেন। তার ফলে বহু বঞ্চিত নারী তাদের অধিকার বুঝে নেওয়াতে সফল হয়েছিল।

(4) ভাবী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা: 

একজন সমাজসংস্কারক হিসেবে রোকেয়ার উত্তরাধিকার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিভিন্ন মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে চলেছে। নারী অধিকার, লিঙ্গ সমতা ও সামাজিক ন্যায় পাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ আজও রোকেয়ার অনুপ্রেরণাকে পাথেয় করে অগ্রসর হয়।

(5) সামগ্রিক প্রভাব: 

সমাজসংস্কারক হিসেবে বেগম রোকেয়ার অক্লান্ত আজীবন প্রচেষ্টা মহিলাদের ক্ষমতায়ন, শিক্ষার উন্নয়ন এবং সামাজিক পরিবর্তনের পটভূমিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে, যা তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগে সুলতানি আমলের শিক্ষা

Leave a Comment