মধ্যযুগে সুলতানি আমলের শিক্ষা | Education during the Sultanate period in the Middle Ages (Class 11 Exclusive Answer)

মধ্যযুগে সুলতানি আমলের শিক্ষা – মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানে শিক্ষাকে একটি পবিত্র কর্তব্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই কারণে মুসলমান শাসকদের আমলে ভারতবর্ষে যে মুসলিম শিক্ষার প্রসার ঘটবে এটা খুবই স্বাভাবিক। মধ্যযুগের মুসলিম শিক্ষার ইতিহাসকে সুলতানি আমলের শিক্ষা এবং মোগল আমলের শিক্ষা এই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুলতানি আমল দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রসারিত। তবে সত্যিকারের মুসলিম অভিযান এদেশে শুরু হয় দ্বাদশ শতাব্দীর বহু পূর্বে গজনির সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের পর থেকে।

মধ্যযুগে সুলতানি আমলের শিক্ষা
মধ্যযুগে সুলতানি আমলের শিক্ষা

মধ্যযুগে সুলতানি আমলের শিক্ষা

(1) সুলতান মামুদের আমলের শিক্ষা (1000-1026 খ্রিস্টাব্দ): 

সুলতান মামুদ ছিলেন শিক্ষা ও সাহিত্যের একজন বড়ো পৃষ্ঠপোষক। বিখ্যাত কবি ফিরদৌসি এবং ঐতিহাসিক আলবিরুনি তাঁর সভা অলংকৃত করেছিলেন। তবে ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর তেমন কোনো অবদান লক্ষ করা যায়নি।

(2) মহম্মদ ঘোরির আমলের শিক্ষা (1174-1206 খ্রিস্টাব্দ): 

মহম্মদ ঘোরি ছিলেন ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপনের পাশাপাশি এদেশে মুসলিম শিক্ষার প্রচলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় তিনি আজমিরে কতকগুলি মন্দির ধ্বংস করে, সেখানে মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

(3) ইলতুৎমিসের আমলের শিক্ষা (1211-1236 খ্রিস্টাব্দ): 

দাস বংশের কুতুবউদ্দিন আইবকের উত্তরাধিকারী ইলতুৎমিস ছিলেন একজন বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি। তিনি দিল্লিতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময়ে দিল্লি পণ্ডিত ও গুণী ব্যক্তিদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। তাঁর কন্যা সুলতানা রিজিয়াও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। সুলতানা রিজিয়া দিল্লিতে উন্নত মানের শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা স্থাপন করেন। এ ছাড়া সুলতান নাসিরুদ্দিনও ছিলেন একজন বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী মানুষ। তিনি নিজের হাতে কোরানের অনুলিপি প্রস্তুত করেন। সুলতান নাসিরুদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মিনহাজ উস সিরাজ ‘তবাকৎ-ই-নাসিরি’ গ্রন্থটি রচনা করেন। নাসিরুদ্দিনের শ্বশুর গিয়াসুদ্দিন বলবন ছিলেন পারসিক সাহিত্যে একজন পণ্ডিত মানুষ। বহু জ্ঞানীগুণী এবং বিদ্বান ব্যক্তি সুলতান গিয়াসুদ্দিনের সভায় উপস্থিত থাকতেন। তাঁর সময়ে দিল্লি এবং দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলগুলি ইসলামীয় শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করে।

(4) খলজি আমলের শিক্ষা (1290-1320 খ্রিস্টাব্দ): 

খলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জালালউদ্দিন খলজি। তিনি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। তাঁর সভায় বহু জ্ঞানী-গুণী এবং বিদ্বান মানুষ উপস্থিত থাকতেন। তিনি রাজকীয় গ্রন্থাগারকে সুসংগঠিত করে তোলেন। শুধু তাই নয়, তিনি আমির খসরুকে রাজকীয় গ্রন্থাগারের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। খলজি বংশের বিখ্যাত সুলতান আলাউদ্দিনও ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। তাঁর সময়ে কবি আমির খসরু, দার্শনিক নিজামুদ্দিন আউলিয়া প্রমুখ শিক্ষাবিদের প্রচেষ্টায় দিল্লি শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে সুনাম অর্জন করে। ঐতিহাসিকদের মতে, আলাউদ্দিনের পুত্র মুবারকও শিক্ষা-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য বহু অর্থ ও ধনসম্পত্তি ব্যয় করেন।

(5) তুঘলকের আমলের শিক্ষা (1320-1413 খ্রিস্টাব্দ): 

তুঘলক বংশীয় সুলতানদের আমলে ইসলামীয় শিক্ষার যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। তুঘলক বংশের প্রথম সম্রাট গিয়াসউদ্দিন ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ। তাঁর আমলে বহু মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। তিনি বিদ্বান ব্যক্তিদের জন্য ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া তুঘলক বংশীয় খ্যাতনামা সম্রাট মহম্মদ-বিন-তুঘলক ছিলেন অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ব্যক্তি। তাঁর শিক্ষাবিস্তারের প্রচেষ্টায় বহু মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবে তাঁর সময়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে দিল্লির সুনাম অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়। ফিরোজশাহ তুঘলক ছিলেন সুলতানী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী সুলতান। তাঁর আমলে ইসলামি শিক্ষা উন্নতির চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।

তিনি তাঁর নতুন রাজধানী ফিরোজাবাদে ফিরোজশাহি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করতেন বিখ্যাত পণ্ডিত জালালউদ্দিন রুমি। রুমি ছিলেন ধর্মশাস্ত্র ও আইন বিষয়ের পন্ডিত। ফিরোজশাহ তুঘলক তাঁর শাসনকালে প্রায় 50টি মক্তব ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন। ফিরোজশাহের অন্য একটি কৃতিত্ব হল তিনি প্রায় 18,000 ক্রীতদাসের জন্য শিক্ষার খরচ বহন করতেন। ওই সকল ক্রীতদাসের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ক্রীতদাস পণ্ডিত ও শিল্পকারিগর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ফিরোজশাহের উদ্যোগে মিরাট থেকে দুটি অশোক স্তম্ভ অক্ষত অবস্থায় দিল্লিতে আনা হয় এবং নতুন করে স্থাপন করা হয়।

তাঁর প্রচেষ্টায় নগরকোটের জ্বালামুখী মন্দির থেকে প্রাপ্ত প্রায় 1300 পান্ডুলিপির অর্থোদ্ধারের জন্য পণ্ডিত নিয়োগ করা হয়। তাঁর সময়েই হিন্দুরা পারসিক ভাষা এবং মুসলিম পণ্ডিতরা সংস্কৃত ভাষা শিখতে শুরু করেন। ঐতিহাসিক রচনা থেকে জানা যায় তিনি তাঁর বেশিরভাগ সময় শিক্ষাবিস্তারে এবং জনহিতকর কার্যে ব্যয় করতেন। সুলতানি আমলে শিক্ষার পাশাপাশি সংগীত, বাদ্য ও চিত্রকলাও সমাদৃত ছিল। ভারতে সাম্রাজ্যবিস্তারকারী সুলতানেরা যে শিক্ষাকে আনুকূল্য দিয়েছিলেন, তা হল ইসলামি শিক্ষা।

To Know More – www.wbhs.in

Leave a Comment