মোগল আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা – ভারতবর্ষে তুর্ক-আফগান শাসনের অবসানের পর মোগল শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন ঘটে। মোগল আমলে ভারতে ইসলামীয় শিক্ষার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। 1526 খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্ত করে বাবর এদেশে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মধ্যযুগে ভারতে ইসলামিক শিক্ষার ইতিহাসে মোগল আমল হল সর্বাপেক্ষা গৌরবময় যুগ।

মোগল আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা
(1) বাবরের আমলের শিক্ষা (1525-1530 খ্রিস্টাব্দ):
বাবর ছিলেন একজন পুথিপ্রেমিক মানুষ। তিনি আরবি, ফারসি, এবং তুর্কি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি কাব্য ও সাহিত্য চর্চার প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। তিনি ‘বাবরনামা’ নামে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। ইসলামিক শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি পারস্য ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে হাতে লেখা বহু পুথি সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন।
(2) হুমায়ুনের আমলের শিক্ষা (1530-40, 1555-56 খ্রিস্টাব্দ):
বাবরের পুত্র হুমায়ুন ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি বিজ্ঞান ও ভূগোল চর্চায় খুবই আগ্রহী ছিলেন। তিনি গ্রন্থপাঠে খুবই আনন্দ পেতেন। তাঁর আমলে বহু মক্তব ও মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়।
(3) শেরশাহের আমলের শিক্ষা (1540-45 খ্রিস্টাব্দ):
শেরশাহের রাজত্বকাল খুবই কম সময়ের। তাঁর পাণ্ডিত্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে তাঁর আমলে জয়পুরের নিকটবর্তী নারমৌলে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে সেই মাদ্রাসাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়।
(4) আকবরের আমলের শিক্ষা (1556-1605 খ্রিস্টাব্দ):
মধ্যযুগের শিক্ষার ইতিহাসে আকবরের অবদান এককথায় অনস্বীকার্য। আকবরের পান্ডিত্য সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও তিনি যে সত্যানুসন্ধানী এবং জ্ঞানপিপাসু ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তিনি একাধারে যেমন ইসলামীয় শিক্ষার বিকাশে সচেষ্ট ছিলেন, তেমনই অন্যদিকে হিন্দুদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে সংস্কৃত ভাষায় লেখা বহু পুস্তক ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। আকবরের প্রচেষ্টায় দিল্লি, আগ্রা এবং ফতেপুর সিক্রিতে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান (কলেজ) স্থাপন করা হয়। শুধু তাই নয়, চিত্রশিল্পের উন্নতিকল্পে তাঁর অর্থানুকূল্যে বিশেষ ধরনের শিক্ষালয় স্থাপন করা হয়। মেধাবী শিল্পীদের জন্য তাঁর প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ধরনের পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া তাঁর উদ্যোগে মক্তব ও মাদ্রাসাগুলিতে হিন্দুরাও শিক্ষালাভের সুযোগ পায়।
‘আইন-ই-আকবরী’ থেকে জানা যায়, মহামতি আকবর মধ্যযুগে প্রচলিত ইসলামিক শিক্ষার সংস্কার সাধনে উদ্যোগী হন। তাঁর সময়ে পাঠক্রমেও বৈচিত্র্য আনা হয়। পাঠক্রমে স্থান পায় নীতিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, কৃষিবিদ্যা, জ্যামিতি, পরিমাপবিদ্যা, জ্যোতিষ, শাসনবিধি, চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, তর্কশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, ভূগোল, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়। আকবরের আমলেই শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
(5) জাহাঙ্গিরের আমলের শিক্ষা (1605-1627 খ্রিস্টাব্দ):
আকবর পুত্র জাহাঙ্গিরও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। জাহাঙ্গিরের আমলে রাজদরবারে চিত্রশিল্পী ও সংগীতজ্ঞদের যথেষ্ট সমাদর করা হত। তাঁর আমলেই বহু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ও পুথি সংগ্রহ করে রাজকীয় গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করা হয়। তাঁর আমলে উত্তরাধিকারহীন বিত্তবান ব্যক্তিদের মৃত্যু হলে তাঁদের সম্পত্তি মক্তব ও মাদ্রাসার উন্নতিকল্পে ব্যয় করার ব্যবস্থা করা হয়।
(6) শাহজাহানের আমলের শিক্ষা (1627-1656 খ্রিস্টাব্দ):
মহামতি আকবর ও জাহাঙ্গিরের তুলনায় শাহজাহানের শিক্ষার প্রতি কম আনুকূল্য ছিল-এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। তবে এ কথাও সত্যি যে, তিনি শিল্প ও স্থাপত্যের একজন খ্যাতিমান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শাহজাহানের পুত্র দারাশিকোও একজন সুপন্ডিত ছিলেন। দারাশিকো আরবি, ফারসি এবং সংস্কৃতে খুবই দক্ষ ছিলেন। বহু সংস্কৃত গ্রন্থকে তিনি ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
(7) ঔরঙ্গজেবের আমলের শিক্ষা (1656-1707 খ্রিস্টাব্দ):
শাহজাহানের পুত্র ঔরঙ্গজেব ছিলেন একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি। ঔরঙ্গজেব আরবি, ফারসি, তুর্কি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। এ ছাড়া আইনশাস্ত্রেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ধর্মপুস্তকের প্রতিও তিনি আকর্ষণ অনুভব করতেন। ইসলামি শিক্ষার জন্য তিনি দরাজ হাতে অর্থ সাহায্য করতেন। মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি রাজকীয় ভান্ডার থেকে অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। মুসলিম ছাত্রদের জন্য তিনি ভাতা ও বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে ‘ফতোয়া-ই-আলমগীরি’ নামে বিখ্যাত ইসলামিক আইনশাস্ত্র সংকলিত হয়। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রে মৌলবি, শিক্ষক এবং অধ্যাপক নিযুক্ত করেন।
তাঁর প্রচেষ্টায় আমেদাবাদ, সুরাট এবং পাটনার বিভিন্ন মক্তব ও মাদ্রাসায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। তাঁর সময়ে শিয়ালকোট বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রে উন্নীত হয়। ওই শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত মৌলানা আবদুল্লা। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায় ঔরঙ্গজেব ইসলামিক শিক্ষার প্রসারের জন্য নতুন নতুন পদ্ধতির কথা চিন্তা করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা-পরিকল্পনায় মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, চরিত্র গঠন, আন্তর্জাতিকতাবাদের শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়গুলি লক্ষ করা যায়।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগে সুলতানি আমলের শিক্ষা