দ্রব্য সম্পর্কে স্পিনোজার মতবাদ

দ্রব্য সম্পর্কে স্পিনোজার মতবাদ

দ্রব্য সম্পর্কে স্পিনোজার মতবাদ
দ্রব্য সম্পর্কে স্পিনোজার মতবাদ

স্পিনোজা দ্রব্যের যে লক্ষণ দিয়েছেন তা দেকার্ত প্রদত্ত দ্রব্যের লক্ষণের পরিমার্জিত রূপ। স্পিনোজা দেকার্ত প্রদত্ত দ্রব্যের সংজ্ঞা স্বীকার করে বলেন যে, ঈশ্বর একমাত্র সত্তাবান দ্রব্য। দেকার্তের মতে, দ্রব্য হল স্বনির্ভর। এই অর্থে ঈশ্বরকেই একমাত্র দ্রব্য বলতে হয়। কিন্তু দেকার্ত ঈশ্বর ছাড়াও দেহ ও মন-কে দ্রব্যরূপে স্বীকার করেছেন। ফলে দেকার্তের দ্রব্যের সংজ্ঞাটি স্ববিরোধিতা দোষে দুষ্ট হয়েছে। দেকার্তের দ্রব্যতত্ত্বের সমালোচনার মধ্য দিয়েই স্পিনোজা তাঁর দ্রব্যতত্ত্বের আলোচনা শুরু করেছেন।

দ্রব্যের লক্ষণ

‘দ্রব্য কী?’ এ প্রশ্নের উত্তরে স্পিনোজা তাঁর ‘Ethics’ গ্রন্থে বলেছেন, দ্রব্য বলতে আমি তাকেই বুঝি যা স্বনির্ভর ও স্ববেদ্য অর্থাৎ অন্য কোনো কিছুর ধারণাকে বাদ দিয়ে যার ধারণা গঠন করা যায়। অন্যভাবে বলা যায়, যা স্বনির্ভরশীল এবং যাকে অন্য কোনো ধারণার সাহায্য ব্যতিরেকেই স্বাধীনভাবে জানা যায় তাই হল দ্রব্য।

দ্রব্য হল স্বনির্ভর ও স্ববেদ্য:

স্পিনোজার মতে দ্রব্যের দুটি অপরিহার্য লক্ষণ হল- (১) স্বনির্ভরতা (Self-dependence) ও (২) স্ববেদ্যতা বা স্ববোধগম্যতা (Self-comprehensibility)। সাধারণত যখন কোনো বিষয় বা ব্যক্তি বা বস্তু নিজের অস্তিত্বের জন্য অপরাপর কোনো কিছুর উপর নির্ভর করে না, তখন তাকে বলে স্বনির্ভর। আর স্বনির্ভর হওয়ার ধর্মটিকে বলে স্বনির্ভরতা। অপরদিকে, স্ববেদ্যতা বলতে বোঝায়, যাকে নিজের সাহায্যেই বোঝা যায়। সুতরাং স্পিনোজার মতে যদি কোনো বস্তুতে স্বনির্ভরতা এবং স্ববেদ্যতা -এই দুটি গুণ থাকে, তবেই বস্তুটি দ্রব্য হিসেবে গণ্য হবে।

দ্রব্য এক এবং অদ্বিতীয়:

স্বনির্ভরতা বা অন্য নিরপেক্ষতা দ্রব্যের লক্ষণ হওয়ায় স্পিনোজার মতে দ্রব্য এক ও অদ্বিতীয়। এই দ্রব্য কখনও সসীম হতে পারবে না, তা অবশ্যই অসীম হবে। এর তাৎপর্য হল, একাধিক দ্রব্য স্বীকার করলে এরা একে অপরের স্বাধীনতায় বিঘ্ন ঘটাবে। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অন্য-নিরপেক্ষ স্বনির্ভর দ্রব্য কখনোই সীমিত হতে পারে না। দ্রব্যের অসীমতা তার স্বনির্ভরতা থেকে অনিবার্যভাবে অনুসৃত হয়। আর যা অসীম তা এক ও অদ্বিতীয় হবে। সুতরাং দ্রব্যের একত্ব তার অসীমত্ব থেকে অনিবার্যভাবে অনুসৃত হয়। এখানেই দেকার্তের মতের সঙ্গে স্পিনোজার মতের পার্থক্য।

দ্রব্য সম্পর্কে দেকার্তের সংজ্ঞা মেনে নিলেও স্পিনোজা দেকার্তের সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। স্পিনোজার মতে দেকার্ত যে সাপেক্ষ দ্রব্যের কথা বলেছেন তা পরস্পর বিরোধী। কারণ স্বনির্ভরতা যদি দ্রব্যের স্বরূপ বা প্রকৃতি হয় তাহলে তা কখনোই সাপেক্ষ হতে পারে না। সেই কারণে স্পিনোজা মনে করেন, দ্রব্য এক এবং তা অন্য-নিরপেক্ষ।

স্পিনোজা দেকার্তের দ্বৈতবাদ অস্বীকার করে দ্রব্য সম্পর্কে যে মতবাদ প্রচার করেছেন তাকে বলা হয় অদ্বয়বাদ (Monism)। তাঁর মতে দ্রব্য হল এক ও অদ্বিতীয়। স্পিনোজা প্রদত্ত দ্রব্যের লক্ষণ অনুসারে ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য। এই একটিমাত্র দ্রব্য স্বীকার করায় স্পিনোজাকে একত্ববাদী বা অদ্বৈতবাদী দার্শনিক বলা হয়। স্পিনোজার মতে দ্রব্য হল সেই সত্তা যার উপর অন্য সবকিছু নির্ভরশীল, কিন্তু দ্রব্য কারও উপর নির্ভরশীল নয়। দ্রব্য সকল বস্তুর কারণ। কিন্তু দ্রব্যের কোনো কারণ নেই, দ্রব্য অ-কারণ। এককথায় দ্রব্য হল বিশুদ্ধ সত্তা, আদি সত্তা এবং নিজের ও অন্য সকলের কারণ। এই দ্রব্য সকল জাগতিক বস্তুর অন্তর্নিহিত মূল কারণ হওয়ায় স্পিনোজা তাঁকে ঈশ্বর নামে অভিহিত করেছেন। ঈশ্বর কোনো বিশ্বাতীত সত্তা নয়, ঈশ্বর এই জগতের অন্তর্নিহিত সত্তা।

বৈশিষ্ট্য

স্পিনোজা বলেন দ্রব্যের সংজ্ঞা থেকে দ্রব্য সম্পর্কে কতগুলি অনিবার্য সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়, যার ভিত্তিতে দ্রব্যের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা হয়। সেগুলি হল-

স্বয়ম্ভু: দ্রব্য অন্য কোনো কিছু থেকে উৎপন্ন না হওয়ায়, দ্রব্য নিজেই নিজের কারণ (Causa Sui)। অর্থাৎ দ্রব্য স্বয়ম্ভু।

অসীম ও অনন্ত: অন্য কোনো কিছু কোনোভাবেই দ্রব্যকে সীমিত করতে পারে না, তাই দ্রব্য অসীম ও অনন্ত।

এক ও অদ্বিতীয়: যদি একাধিক দ্রব্য থাকত তাহলে একটি অপরটির দ্বারা সীমিত হয়ে পড়ত। এর ফলে কোনোটিই অসীম হত না। দ্রব্য তাই এক ও অদ্বিতীয়।

শাশ্বত বা চিরন্তন: উৎপত্তি ও বিনাশ না থাকায় দ্রব্য শাশ্বত বা চিরন্তন।

নির্গুণ ও নির্বিশেষ: দ্রব্য অনন্ত গুণসম্পন্ন হওয়ায় দ্রব্যকে কোনো একটি গুণের দ্বারা বিশেষিত করা যায় না। কারণ কোনো একটি গুণের দ্বারা বিশেষিত করলে অপরাপর গুণগুলির অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই দ্রব্য নির্গুণ, নির্বিশেষ।

সারসত্তা ও আদি কারণ: দ্রব্য হল সারসত্তা ও আদি কারণ। মানসিক ও ভৌতিক সকল পদার্থের সারসত্তা বা আদি কারণ হল দ্রব্য। অর্থাৎ যাবতীয় জাগতিক ও মানসিক বিষয় দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল।

উপরের আলোচনার ভিত্তিতে তাই স্পিনোজাকে অনুসরণ করে দ্রব্যের লক্ষণ হিসেবে বলা যায়- দ্রব্য হল এক, অদ্বিতীয়, অসীম, অনন্ত, শাশ্বত, স্বয়ম্ভু, স্বনির্ভর, নির্গুণ ও নির্বিশেষ সত্তা।

ঈশ্বরের দুটি গুণ (বিস্তৃতি ও চেতনা)

স্পিনোজা বলেছেন ঈশ্বর তথা দ্রব্য অনন্ত গুণের অধিকারী। তবে মানববুদ্ধি এই অসীম সংখ্যক গুণের মধ্যে মাত্র দুটি গুণকে জানতে পারে- চেতনা (Consciousness) ও বিস্তৃতি (Extension)। এই গুণ দুটি অবভাস (Appearance) হলেও স্পিনোজা মনে করেন এই গুণগুলি ঈশ্বরসত্তা অনুভবের একমাত্র মাধ্যম বা আকার (Forms of knowledge of God)। অপরদিকে জীবাত্মা ও জড়বস্তু হল ঈশ্বরের এই দুটি গুণের সমান্তরাল প্রকাশ। জীবাত্মা হল অনন্ত চেতনার প্রকাশ, আর জড়বস্তু হল অনন্ত বিস্তৃতির প্রকাশ। যেহেতু মানুষ নিজেকে জড়দেহ ও চেতন মনের অধিকারীরূপে প্রত্যক্ষ করে, তাই ঈশ্বরের অনন্ত গুণসমূহের মধ্যে এই দুটি গুণই মানুষের কাছে বোধগম্য।

সমান্তরালবাদ

চেতনা ও বিস্তৃতি- ঈশ্বরের এই দুটি মৌলিক গুণ বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হওয়ায় ও তাদের মধ্যে কোনো সাধারণ লক্ষণ না থাকায়, একটি গুণ অপর গুণের কারণ হতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও গুণ দুটি একই দ্রব্য- ঈশ্বরের দুটি দিক। আর মন বা জীবাত্মা এবং দেহ বা জড়ের মধ্য দিয়েই গুণ দুটি সমান্তরালভাবে প্রকাশিত হয়। তাই স্পিনোজা মনে করেন দেহ ও মন হল একই বক্ররেখার দুটি তল। উত্তল (Convex) ও অবতল (Concave)।

স্পিনোজার মতে প্রতিটি বিস্তারের সঙ্গে একটি চিন্তন এবং প্রতিটি চিন্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি বিস্তার থাকে। তাই প্রতিটি দৈহিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক পরিবর্তন এবং প্রতিটি মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে দৈহিক পরিবর্তন দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে একটি উপমা দিয়ে তিনি বলেছেন দুটি সমান্তরাল রেখা যেমন একটি অন্যটির উপর নির্ভর না করে, একে অন্যের সঙ্গে মিলিত না হয়ে সমানতালে একইদিকে অগ্রসর হয়, দৈহিক ও মানসিক অবস্থাও তেমন একটি অন্যটির সঙ্গে মিলিত না হয়ে একযোগে পরিবর্তিত হয়। এই কারণেই স্পিনোজার এই মতবাদকে সমান্তরালবাদ (Parallelism) বলা হয়। অনেকে দেহ-মন সংক্রান্ত স্পিনোজার এই মতকে দ্বিভঙ্গিবাদ (Double Aspect Theory)-ও বলেছেন।

স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদ

স্পিনোজার মতে জড় ও আত্মা নেই, তেমনি ঈশ্বর বা দ্রব্য ছাড়া জীব ও জগতের নিয়েই জগৎ। জড় ও মন হল ঈশ্বরের অনন্ত বিস্তৃতি ও অনন্ত চেতনার প্রকাশমাত্র। তাই সমগ্র জীবজগৎ ও জড়জগৎ ঈশ্বরের অন্তর্ভুক্ত এবং ঈশ্বরই সকল বস্তুর আশ্রয়। সমুদ্র ছাড়া যেমন সমুদ্রতরঙ্গের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কোনো পৃথক অস্তিত্ব নেই। এককথায়, সবকিছুই ঈশ্বর এবং ঈশ্বরই সবকিছু (All is God and God is all)। সবকিছুই ঈশ্বরের পূর্ণ সত্তা থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়ে আবার তারই মধ্যে নিহিত হয়ে আছে। তাঁর মতে, জগতের যা কিছু আছে, তা ঈশ্বরেই আছে এবং ঈশ্বর ছাড়া কোনো কিছুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। স্পিনোজার এই মতবাদকে সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism) বলা হয় এবং স্পিনোজাকে সর্বেশ্বরবাদী দার্শনিক (Pantheist) বলা হয়।

দ্রব্য = ঈশ্বর = প্রকৃতি

স্পিনোজার মতে দ্রব্য, ঈশ্বর ও প্রকৃতি অভিন্ন। প্রকৃতির সকল বস্তু নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দ্রব্য সত্তার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু পরমসত্তা বা ঈশ্বর নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অন্য কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। এখানে প্রকৃতি বলতে জগৎকে নয় বরং ঈশ্বরকেই বোঝানো হয়েছে। কেন-না প্রকৃতিতে যা কিছু আছে তা ঈশ্বরের মধ্যেই আছে, ঈশ্বরের বাইরে কোনো কিছু নেই। তাই স্পিনোজার দর্শনে ‘দ্রব্য’ বা ‘ঈশ্বর’ দ্বারা সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতিকে বুঝতে হবে। সুতরাং বলা যায় যে, দ্রব্য = ঈশ্বর = প্রকৃতি (Substance = God = Nature) |

সৃজনী প্রকৃতি ও সৃষ্ট প্রকৃতি

এই জগতকে অথবা জড়বস্তুসমূহ ও মানসিক ধারণা বা অবস্থাসমূহকে বলা হয় বিকার (Modes)। ঈশ্বর চেতনা ও বিস্তৃতির দ্বারা জগতরূপে আমাদের কাছে প্রকাশিত হন। স্পিনোজার মতে ঈশ্বর জগতের অন্তর্নিহিত কারণ। তিনি জগতের স্রষ্টা নন। তিনি জগতের প্রাণপুরুষ, জগতের প্রতিটি বস্তুতে ঈশ্বরের অবস্থান। ঈশ্বর জগতের অন্তর্বর্তী হয়ে জাগতিক বস্তুর সূচনা করেন। অর্থাৎ তাঁর মতে ঈশ্বর হল সৃজনীশক্তি (Natura Naturans), জগৎ সৃজনশক্তি (Natura Naturata), যে শক্তি থেকে জ্যামিতিক অনিবার্য নিয়মে জগতের উদ্ভব ঘটেছে। সৃজনী প্রকৃতি হল দ্রব্য যা প্রকৃতি বা ঈশ্বরের অব্যক্ত রূপ আর সৃষ্ট প্রকৃতি হল তারই ব্যক্ত অবস্থা।

সমালোচনা

স্পিনোজার দ্রব্য সম্পর্কিত মতবাদটি সর্বাঙ্গীণভাবে সন্তোষজনক নয়।

শূন্যগর্ভ অদ্বৈতবাদ:

এই মতবাদ বহুত্বকে অস্বীকার করে এবং কেবলমাত্র ‘এক’-এর অস্তিত্বকে স্বীকার করে। কিন্তু বহুত্ববর্জিত – ‘ঐক্য’ বা ‘এক’ একটি নিছক শূন্য ধারণা মাত্র। শূন্যতা দিয়ে জগতের বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদ এক শূন্যগর্ভ অদ্বৈতবাদে পরিণত হয়েছে। হেগেল (Hegel) যথার্থই বলেছেন, “স্পিনোজার দ্রব্য যেন একটি সিংহের গুহা, যেখানে প্রবেশ করার বহু পদচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসা কোনো পদচিহ্নই দেখতে পাওয়া যায় না।”

অপরিণামী ঈশ্বর থেকে পরিণামী জগতের কল্পনা:

দ্রব্য সত্তা বা ঈশ্বর যদি এক, অদ্বিতীয়, অসীম ও অপরিণামী হয়, তাহলে তার থেকে পরিণামী জগতের গতি, বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনের ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ যা সসীম, তার এক স্তর থেকে অন্য স্তরে গতি বা পরিবর্তন সম্ভব; কিন্তু যা অসীম তার কোনো গতি বা পরিবর্তন সম্ভব নয়।

আত্মা ও জড় সমপর্যায়ভুক্ত নয়:

স্পিনোজার দর্শনে আত্মা ও জড় অর্থাৎ চেতনা ও বিস্তৃতি সমপর্যায়ের। কিন্তু এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ চিন্তা বা চেতনা বিস্তৃতিকে জানতে পারে; কিন্তু বিস্তৃতি চিন্তাকে জানতে পারে না।

ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বিষয়ক অসংগতি :

স্পিনোজা ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্ককে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তিনি বলেছেন, অবরোহ পদ্ধতিতে যেমন ‘ত্রিভুজের ধারণা’ থেকে ‘ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণ’ -এই ধারণা নিঃসৃত হয়, ঠিক তেমনই ঈশ্বরের ধারণা থেকে জগতের ধারণা নিঃসৃত হয়। কিন্তু এভাবে জ্যামিতিক পদ্ধতির দ্বারা জগতের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। ঈশ্বর হল বিমূর্ত ধারণা, কিন্তু জগৎ হল মূর্ত বাস্তব বিষয়। সুতরাং স্পিনোজা ঈশ্বর ও জগতের মধ্যে সম্পর্ককে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি।

জগতের অকল্যাণের অস্বীকৃতি:

স্পিনোজার মতে জগতে যা কিছু ঘটে তা ঈশ্বরের অলঙ্ঘ্য নিয়মেই ঘটে, ভিন্নরকম ঘটনা ঘটার কোনো যৌক্তিক সম্ভাবনা নেই। কিন্তু স্পিনোজার এই মত সমর্থন করলে বলতে হয় যে, জগতের অমঙ্গলজনক ও অকল্যাণকর ঘটনাগুলিও ঈশ্বর নির্দেশিত। কেন-না জগতে যা কিছু ঘটে তা ঈশ্বরের অনিবার্য নিয়মেই ঘটে। অর্থাৎ জীবের ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই। এক্ষেত্রে আমাদের নৈতিক জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষের জীবনে নৈতিকতাকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না।

মন ও দেহের অভিন্নতা:

আধুনিক কালে মনকে দেহেরই ‘স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। গিলবার্ট রাইল তাঁর ‘Concept of Mind’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু স্পিনোজার সমান্তরালবাদ তত্ত্বে মন যে দেহেরই ভিন্ন প্রকাশ তা আদৌ স্বীকার করা হয় না।

সর্বমনবাদের উদ্ভব:

স্পিনোজার তত্ত্বকে স্বীকার করলে সমস্ত দৈহিক ক্রিয়ার সমান্তরালভাবে মনের একটি ক্রিয়াকে সমর্থন করতে হয়। ফলে সর্বমনবাদ তত্ত্বের উদ্ভব হয়। সব কিছুর মন আছে-এমন তত্ত্ব স্বীকার্য নয়, কারণ সেক্ষেত্রে জড়বস্তুরও চেতনা আছে-এ কথা স্বীকার করতে হবে।

আরো পড়ুন : পোটরাজ গল্পের MCQ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment